কুরআনের সরল সৌন্দর্য

 কুরআনের সরল সৌন্দর্য

(বিস্তারিত কমেন্টে)

আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?

হাদিসের জটিলতায় যাওয়ার আগে কুরআনের সারল্য ও সম্পূর্ণতা নিশ্চিত হওয়া যাক।

সূরা আল-কামারে চারবার (১৭, ২২, ৩২, ৪০ নম্বর আয়াতে) আল্লাহ একই আয়াতের পুনরাবৃত্তি করেছেন-

আর আমি কুরআনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি, তাহলে উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?(কুরআন, আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী)

আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?

একই ধরনের রেফারেন্স দিয়ে বক্তব্য দীর্ঘ করার চেয়ে মূল ধারণা পরিষ্কার করব। একটা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বা মাইন্ডসেট নিয়ে নিজে কুরআন পড়লেই দেখবেন সব জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর দেয়া আছে।

কুরআন যে সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, বিস্তারিত এবং প্রায়োগিক তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

সূরা বাকারা, আয়াত-২

This is the Book about which there is no doubt, a guidance for those conscious of Allah. (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

এই হচ্ছে সেই কিতাব যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, মুত্তাকী বা আল্লাহর প্রিয়ভাজনদের জন্য হেদায়া বা পথনির্দেশক। কুরআনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এতে জাল, জয়িফ, হাসান কোনো আয়াত নেই এবং কুরআনই মুত্তাকীদের জন্য জিপিএস বা পথপ্রদর্শক।

সূরা শুরারা, আয়াত-২

এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

এগুলো হচ্ছে সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত- (সূরা নূর, আয়াত-৩৪)

And We have certainly sent down to you distinct verses. (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল) আমি অবশ্যই তোমার ওপর সুস্পষ্ট আয়াত নাজিল করেছি।

সুতরাং কুরআনের অস্পষ্টতার অভিযোগ অবান্তর এবং মিথ্যাচার।

সূরা ফুসসিলাত-এর ৩ নম্বর আয়াতে আরো বলা হয়েছে-

একটি কিতাব যার আয়াত বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

এই কিতাবের প্রতিটা আয়াত বিশদ, বিস্তারিত।

সূরা আল আন' আমের ৩৮ নম্বর আয়াত।

আমরা কিতাবের কিছু মিস করিনি। অথবা আমরা রেজিস্টারে কোনো বিষয় অবহেলা করিনি। (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

আমি এই কিতাবে কোনো কিছুকেই বাদ দেইনি।

সূরা নাহলের ৮৯ নম্বর আয়াত

আর আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা স্বরূপ এবং মুসলমানদের জন্য হেদায়েত ও রহমত ও সুসংবাদ স্বরূপ। (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

আমি তোমার ওপর এই কিতাব নাজিল করেছি সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট বিবরণ এবং মুসলমানদের জন্য গাইডেন্স, ক্ষমা ও সুসংবাদ হিসেবে।

সুতরাং কুরআন বিশদ বা বিস্তারিত নয়- এটা ডাহা মিথ্যা কথা।

কুরআন কতখানি বিশদ?

সূরা কাহাফ ১০৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন।

বলুন, "আমার প্রভুর বাণী [লেখার] জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রভুর বাণী শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যেত। (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)


হে নবী আপনি বলুন, যদি আমার প্রতিপালকের কথার তাৎপর্য লেখার জন্য সমুদ্রের পানিও কালি হয় তবে সমুদ্রের পানি শেষ হয়ে যাবে আমার প্রতিপালকের কথা বা শব্দের তাৎপর্য লেখা শেষ হবে না।

এটা একটা রূপক উপমা। কুরআনের মর্যাদা, সার্বজনীনতা, প্রায়োগিক সক্ষমতা, সুফল কত সীমাহীন, কত সুদূরপ্রসারী, কত তাৎপর্যপূর্ণ তা বোঝাতে আল্লাহ এ উপমা ব্যবহার করেছেন।

নবীজির মোজেজা সম্পর্কে অনেক ভিত্তিহীন বানোয়াট গল্প প্রচলিত থাকলেও আমাদের নবীজির (সা.) মোজেজা ছিল কুরআন। কুরআন তার নিরবচ্ছিন্ন অনুসারীদের এক যুগেরও কম সময়ে ধুলামলিন বেদুইন থেকে সারা পৃথিবীর অবিসংবাদিত অধিপতি বানিয়ে প্রমাণ করেছে কুরআন সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে সাফল্যের চিরন্তন পথপ্রদর্শক। কুরআনের শ্রুতি এবং ছন্দের সাথে শব্দ, বাক্য এবং উপমার যে ব্যাপ্তি তা-ই কুরআনের স্বাতন্ত্র্য বিস্ময়। সংক্ষিপ্ত আবার সীমাহীন।

এখানে অনেকে হাদিস তাফসিরকেই কুরআনের তাৎপর্য বলছেন কিন্তু কুরআনের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তাৎপর্য, বর্ণনা, বিবরণ যা-ই হোক তা কুরআনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারবে না।

পাঁচবার অজুর পর শাহাদা পাঠ করলে তার জন্য বেহেশতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে বা টাখনুর নিচে কাপড় পরলে সে জাহান্নামি-এই সহিহ হাদিসগুলো কুরআনের কোন কোন আয়াতের তাৎপর্য বা ব্যাখ্যা?

কুরআনের অতিরিক্ত ব্যাখ্যা যাদের প্রয়োজন তাদের সম্পর্কে সূরা আল ইমরানের ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কার করে বলেছেন।

তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। এতে মৌলিক বা মৌলিক (প্রতিষ্ঠিত অর্থ) আয়াত রয়েছে। তারা কিতাবের ভিত্তি: অন্যগুলো রূপক। কিন্তু যাদের অন্তরে বিকৃততা রয়েছে তারা এর যে অংশটি রূপক, মতভেদ খোঁজে এবং এর গোপন অর্থ অনুসন্ধান করে, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া কেউ এর গোপন অর্থ জানে না। 

আর যারা জ্ঞানে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত তারা বলে: "আমরা কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছি; এর পুরোটাই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে" এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ এই বাণী উপলব্ধি করবে না।

-কুরআন, আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী

তিনিই তোমার ওপর কিতাব নাজিল করেছেন, তার মধ্যে আছে মুহকাম আয়াতসমূহ। সেগুলো কিতাবের মূল, আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ। ফলে যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে। 


অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবগুলো আমাদের রবের পক্ষ থেকে। আর বিবেকসম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে।

এ আয়াতেরও কি ব্যাখ্যা লাগবে?

শুধু 'মুকাম' শব্দের অর্থটা একটু পরিষ্কার করি। মুকাম-এর মূল শব্দ হুকুম, এটা বাংলায়ও ব্যবহৃত হয়। আমরা একমাত্র আল্লাহর হুকুম' মানি। আল্লাহ কুরআনের কিছু আয়াতে আমাদের 'হুকুম' দিয়েছেন। এই হুকুমসংবলিত আয়াত বা মুকাম আয়াতগুলো সহজ এবং স্পষ্ট। 

হুকুম আহকাম বা বিধি- বিধানসংক্রান্ত কিছু উদাহরণ নোয়াহর প্রশ্নের জবাবে আলোচনা করেছি, পরবর্তীতে আরো কিছু উদাহরণ দেখব। এর বাইরেও কুরআনে আল্লাহ বিভিন্ন উদাহরণ, উপমা দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন।

 কুরআনের অনেক আয়াত রূপক। কিছু আয়াত শুধু নবীজির জন্য প্রযোজ্য, নবীজির স্ত্রীদের জন্য প্রযোজ্য, কিছু আয়াত একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। কিছু আয়াত কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিলকৃত। এই মোতাশাবিহ আয়াতগুলোর অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জানার প্রয়োজন ও নেই। আমাদের সেগুলোকে কুরআনের অংশ হিসেবে বিশ্বাস করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

মুহকাম বা হুকুম আহকামসংবলিত আয়াতগুলোই কুরআনের মূল। আর এর বাইরে কুরআনের ভাষায়- "যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে।"

আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপের প্রকৃত ব্যাখ্যা আমরা জানি না। চন্দ্রকে বিদীর্ণ করা হয়েছে। এর অর্থ যাদের জন্য প্রযোজ্য তারা বুঝেছে, আমাদের এ নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনি রচনার প্রয়োজন নেই।

মেরাজ সম্পর্কে যত মেগাসিরিয়াল আমরা জানি তার ভিত্তি কুরআনের একমাত্র আয়াত (সূরা ইসরা-০১)

পবিত্র তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে মসজিদুল হারাম (মক্কায়) থেকে দূরের মসজিদে (জেরুজালেমে) নিয়ে গিয়েছিলেন যার চারপাশে আমরা বরকত দান করেছি যাতে আমরা তাকে আমাদের কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

- তাফহীম-উল-কুরআন আবুল আলা মওদুদী

"পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।"


এ আয়াতে মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মাসজিদুল আকসায় নবীজির রাত্রিকালীন সফরের কথা বলা আছে। এ সফর শারীরিক, আধ্যাত্মিক বা স্বপ্নযোগেও হতে পারে।

কিন্তু তার সাথে আমাদের করণীয় কিছুই নেই। আমাদের শুধু বিশ্বাস করতে হবে এ কথাটা আল্লাহর। এর প্রকৃত সত্য আল্লাহই ভালো জানেন।

যেমনটা আল্লাহ বলেছেন-

"আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবগুলো আমাদের রবের পক্ষ থেকে। আর বিবেকসম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে।"

কুরআনে মেরাজ সম্পর্কে আর কোনো কথা নাই। কিন্তু আমরা এ নিয়ে মস্ত বড় এক ঢেকি বানিয়ে সেটাকে গেলা এবং গেলানোর চেষ্টা করছি।

এ সবই ধর্ম নিয়ে দিনভর বিতর্কের বিষয়বস্তু। অথচ এগুলোর সোজা উত্তর এগুলো নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই, এগুলো গুগলের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের মতো আপনাকে বুঝতে হবে না কিন্তু এগ্রি করতে হবে।

কুরআনের সাথে হাদিস বা অন্য কিছু মিশিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত দেয়ার বা কুরআনের ওই আয়াত মানসুখ বা বাতিল বলা সম্পর্কে সূরা কা-এর ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

এবং পাঠ করুন, [হে মুহাম্মদ], আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার কিতাব থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর বাণীর কোন পরিবর্তনকারী নেই, এবং তিনি ব্যতীত অন্য কোথাও আপনি আশ্রয় পাবেন না। (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

"হে নবী আপনি পড়ুন, তোমার প্রভুর এই কিতাব থেকে তোমার নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে, তার শব্দাবলির কোনো পরিবর্তনকারী নেই এবং আপনি কখনোই আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পাবেন না।"

সুতরাং কুরআনের পরবর্তী আয়াত দ্বারা আগের আয়াত মানসুখ বা বাতিল হয়ে গেছে-এটাও কুরআন বিরুদ্ধ কথা। কোনো বিষয়ে দুই আয়াতে দুই রকম থাকলে যা সহজ, সুবিধাজনক বা সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতিতে উত্তম তা পালনীয় কিন্তু দুই আয়াতই বহাল। কোনো অংশকে মানসুখ বলার সুযোগ নেই সূরা বাকারাহ, আয়াত-৮৫

So do you believe in part of the Scripture and disbelieve in part? (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করবে আর কিছু অবিশ্বাস করবে? সূরা আরাফ, আয়াত-৩

তোমরা সবাই অনুসরণ করবে যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে এবং তাঁকে বাদ দিয়ে অনুসরণ করো না।(সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

"হে মানুষেরা তোমরা সকলে তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাকে ছাড়া অন্য কিছু অনুসরণ কোরো না। এ আয়াত অনুযায়ী কুরআনের বাইরে ভিন্ন কিছু অনুসরণের অনুমতি আছে?


সূরা আন'আমের ১৯ নম্বর আয়াতে কুরআনের সাথে অনুমোদনহীন কিছুর সংমিশ্রণকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন। আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে-

"হে নবী, আপনি বলুন সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে শাহাদাহ বা সাক্ষ্য দেয়া।"

এরপর বলেছেন- বলুন, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং আমার প্রতি এই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে যে, আমি

may warn you thereby and whomever it reaches." "হে নবী, আপনি বলুন-তোমাদের এবং আমার মধ্যে আল্লাহ সাক্ষী-আমার ওপর এই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে-যাতে আমি এই কুরআন অনুযায়ী তোমাদের এবং যাদের কাছে এই কুরআন পৌঁছায় তাদের সতর্ক করতে পারি।"

এবং আয়াতের শেষ অংশে আল্লাহর কমান্ডের সাথে অননুমোদিত কোনো বিধি নিষেধ যুক্ত করা সম্পর্কে পরিষ্কার হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে।

Say, 'He is only one God, and I disown whatever you join with Him.' Abdul Haleem, The Qur'an, Oxford University Press, "হে নবী, আপনি বলুন, নিশ্চয় তিনিই একমাত্র ইলাহ বা বিধানদাতা, আর তোমরা তার সাথে যা শরিক করো বা সংযোজন করো আমি তার থেকে মুক্ত।

দেখুন লক্ষ লক্ষ হাদিস আর ফিকহী বিশ্লেষণের ওপর যেখানে সিংহ ভাগ ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ, বিধি-বিধান দাঁড়িয়ে সেখানে এ মর্মে কুরআনে অন্তত একটি সুস্পষ্ট আয়াত কি থাকা উচিত নয়?

যেমন-হে নবী, আপনি আপনার সাহাবিদের বলুন তারা যেন কুরআনের পাশাপাশি আপনার সকল কথা, কাজ এবং অনুমোদের বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে। কারণ তা কুরআনের মতোই অবশ্য পালনীয়। কিন্তু এমন কোনো আয়াত তো নাই-ই, বরং কুরআন একমাত্র কুরআনকেই সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, বিশদ, বিস্তারিত, অপরিবর্তিত, অনুকরণীয় পথনির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সূরা বাকারা, আয়াত-৪২

আর সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না। (সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কোরো না।

অর্থাৎ বিন্দুমাত্র সন্দেহাতীত কুরআনের সাথে জাল জয়িফ হাসান এবং অমুকের মতে সহিহ কোনো কিছু মিশ্রিত করার কোনো সুযোগ নেই।

সূরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে অনুমোদন করলাম।

(সহিহ ইন্টারন্যাশনাল)

"আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে অনুমোদন দিলাম।"

অতএব কুরআন আমাদের জন্য সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, অনুমোদিত জীবনবিধান আল্লাহ কুরআনের বাইরে অন্যান্য আসমানি কিতাবকেও নিঃশর্ত বিশ্বাসের নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু কোনো মানবরচিত সংগৃহীত বা সংকলিত কোনো গ্রন্থকে ধর্মীয় বিধান হিসেবে অনুমোদন দেননি। এই আয়াতগুলো দিয়ে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, কুরআন সহজবোধ্য, সম্পূর্ণ, বিশদ এবং প্রায়োগিক।

তবুও অনেকেই বলতে পারেন কুরআনে তো অনেক কিছুই বলা নেই। মানে আমাদের পছন্দের অনেক কিছু নেই। যেটা দিয়ে আমাদের দল, মত বা তরিকাকে বৈধতা দেয়া যায় এবং তা পালনে মানুষকে বাধ্য করা যায়। 

কুরআন তথা ইসলাম হচ্ছে সকল যুগের, সমগ্র বিশ্বের সব মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবনবিধান। একটা দেশের সংবিধান ছোট্ট ওয়ালেট সাইজ একটা বই। কিন্তু এই সংবিধানই প্রতিটা দেশের সর্বোচ্চ আইন। আপনি এক মিলিয়ন আইন বানাতে পারেন কিন্তু তা সংবিধানের সীমার বাইরে যেতে পারবে না।


 সংবিধানেই বলা আছে কীভাবে একজন আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হবেন, কীভাবে আইনপ্রণেতারা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন, কীভাবে একটা আইন প্রণয়ন করবেন, এ সকল সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই সেটা সাংবিধানিক আইন। 

কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবিধানকে কাগুজে রীতি হিসেবে রেখে বিভিন্ন 'ক্ষমতার নিরাপত্তা আইন' প্রণয়ন করা হয়। এসব আইনের একটা যেনতেন সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও বাস্তবে এসব আইন সংবিধানের বিধান নয়। এগুলো কার্যত সংবিধানের সং।

একইভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যাবতীয় ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ কুরআনের বিধান নয়। কুরআনের সাথে যেনতেন একটা সম্পর্ক দেখিয়ে দিন শেষে ঢেকি গিলিয়ে দেয়া হয়।

আপনি এক বিলিয়ন বিধি-বিধান প্রণয়ন করেন কিন্তু তা কুরআনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারবে না। কুরআন যেটাকে হারাম বলেনি সেটাকে হারাম বা যেটাকে বাধ্যতামূলক করেনি তাকে আবশ্যকীয় বলার কোনো সুযোগ নেই। সূরা ইউনূস, আয়াত ৫৯

বলুন, 'আল্লাহ আপনার জন্য যে রিজিক নাযিল করেছেন, তার কিছুকে হারাম এবং কিছুকে হালাল করেছেন সে সম্পর্কে চিন্তা করুন।' বলুন, 'আল্লাহ কি আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন, নাকি আপনি ঈশ্বর সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করছেন?'

আব্দুল হালিম, কোরান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।

"হে নবী আপনি বলুন তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তোমরা কোনো কিছুকে হালাল এবং কোনো কিছুকে হারাম বলার কোনো সুযোগ আছে? বলুন আল্লাহ তোমাদের সে অনুমতি দিয়েছে? না তোমরা আল্লাহর নামে কিছু বানিয়েছো?

আপনি কুরআনবহির্ভূত যাবতীয় রীতি-রেওয়াজ ধর্ম থেকে বাদ দিলে ধর্মবিরোধী প্রায় সব অভিযোগই ভিত্তিহীন হয়ে পড়বে। 

কারণ যারা ধর্মের সমালোচনা করছে তারা মূলত ধর্মের নামে ঢেঁকি গেলানোর সমালোচনা করছে। আপনি অবশ্যই দাড়ি রাখতে পারেন, দাড়ি পুরুষের সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্বের প্রতীক। দাড়ি রাখতে কুরআনে নিষেধ করা হয়নি, টুপি-পাগড়ি-আলখাল্লা আপনার রুচি পছন্দের হলে কোনো সমস্যা নেই। 

কিন্তু আপনি দাড়ি রাখাকে কি ফরজ বা ওয়াজিব বা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে ফেলতে পারেন? কারণ কুরআনে দাড়ি রাখতে বলা হয়নি। নবীজির দাড়ি ছিল বলে আমরা জানি, তা আবু জেহেলেরও ছিল। সব সাহাবির যেমন ছিল সব কাফের মুশরিকদেরও ছিল।

ক্রুসিফাইড যিশুর যেমন দাড়ি আছে ইহুদি রাবাইদদেরও দাড়ি আছে। যোগী, ঋষি, শিখ সব ধর্মের এমনকি অধর্মের লোকেরা ফ্যাশন বা সময়ের আবর্তে দাড়ি রেখেছেন বা রাখছেন। সময় ঘুরে এখন আবার দাড়ি রাখা টাখনুর উপর প্যান্ট পরার ফ্যাশন এসেছে।

 তো দাড়ি কেবল ইসলাম ধর্মের প্রতীক হয় কীভাবে? তোমরা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত কোরো না-এই আয়াতের ভিত্তিতে অনেকে দাড়ি কাটাকে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি বলেছেন, তো এই যুক্তিতে তো চুল, মোচ, নখ কিছুই কাটা যাবে না।

যারা হিজাব পরেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান রেখে বলছি, হিজাব এবং নিকাব-এই শব্দ দুটি কুরআনের যে আয়াতে এসেছে তার সাথে ড্রেসকোডের কোনো সম্পর্ক নেই। 

মহিলাদের ড্রেসকোড নিয়ে কুরআনের ৬ সহস্রাধিক আয়াতের মধ্যে মাত্র তিনটি আয়াত আছে, যার একটি নবীজির স্ত্রীদের জন্য। বাকি দুই আয়াতের একটিতে মহিলাদের একটি ওড়না বা কাপড় দিয়ে বুক ঢেকে রাখতে এবং অপর আয়াতে একটি চাদর ঝুলিয়ে পরতে বলেছে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবেও যাতে তাদের উত্ত্যক্ত না হতে হয়। 

মহিলাদের পোশাকের বিধান যেহেতু একটু স্পর্শকাতর তাই একটি আলাদা অধ্যায়ে আলোচনা করব। কুরআন পোশাকের সাধারণ নীতিমালা বলে দিয়েছে আর তা হচ্ছে সুন্দর, অভিজাত বা রুচিশীল পোশাক।

 সুতরাং রুচিশীল, সুন্দর পোশাকই ইসলামি পোশাক। হিজাব বা নেকাব যদি আপনি অভিজাত, রুচিশীল মনে করেন ঠিক আছে কিন্তু যারা আগে নেকাব পরতেন না কিন্তু ধর্মচর্চা শুরু করার পর নেকাব পরছেন, তারা ঢেঁকি গিলছেন এবং ঢেকি আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন।

ইসলাম কোনো লিমিটেড কোম্পানি নয় যে, আলাদা লেবেল বা লোগো থাকতে হবে। নবীজিসহ সাহাবিদের কারোরই নাম বা পোশাক নবুওয়াত প্রাপ্তির পর বা ইসলাম গ্রহণের পর পরিবর্তন করা হয়নি।

 মুসলিম নারী- পুরুষরা সমাজে প্রচলিত শালীন, মার্জিত হিসেবে বিবেচিত এমন পোশাকই পরতেন। নাম, পোশাক দিয়ে অবশ্যই একজন মানুষের মূল্যায়ন হওয়া উচিত নয়। ইসলামে একজন মানুষের মূল্যায়ন হয় তার উত্তম চরিত্র বা সৎকর্ম দিয়ে।

আপনি হয়তো আমার কথা মানতে পারছেন না। আমার কথা আপনাকে মানতে হবেও না। আমি এ কথাটাই বলছি সবার সব কথা শুনবেন কিন্তু মানবেন কুরআনের কথা। 

আমি কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো সামনে আনছি, রেফারেন্স দিচ্ছি, অনুবাদ এবং আমার উপলব্ধি ভাগাভাগি করছি আপনি কুরআনের অন্যান্য অনুবাদ দেখুন, কোনো আলেমের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা চান, এসব যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিন। কারো ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত নয় । আপনি আপনার চিন্তা-গবেষণা করে যেটা যৌক্তিক মনে হবে সেটা করবেন- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কারো সাথে তর্কে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। 


কে কোন হাদিস বিশ্বাস করবে, কোন কিতাব বিশ্বাস করবে সেটা তার ব্যাপার। তাফহীমুল কুরআন, তাফসীরে জালালাইনের মতো প্রাচীন তাফসিরগুলোর অনেক ব্যাখ্যা সে সময়ে যৌক্তিক মনে হলেও আমাদের সময়ে অপ্রাসঙ্গিক ইবনে কাসীরসহ অধিকাংশ তাফসিরকারক একমত যে, কুরআনের তাফসির হতে হবে কুরআনভিত্তিক।

 অর্থাৎ কুরআনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সব আয়াত এক করলেই সে বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু অধিকতর পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য তাফসির, হাদিস, ফিকহ নিয়ে যত গবেষণা করবেন জটিলতা বাড়বে, কমবে না।

কুরআনকে আমরা আমাদের সময়ের জ্ঞান অনুযায়ী যা বুঝি আমাদের জন্য তা-ই কুরআনের বিধান। অনেকেই আশা করেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বা মহাবিশ্ব সম্পর্কে কুরআন সুনির্দিষ্ট করে বললে তো আমাদের বিশ্বাস করতে সহজ হতো। কিন্তু আমার জন্য সহজ হলে সেটা আরেকজনের জন্য কঠিন হতো। 

যেমন-কুরআনে যদি ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের কথা লেখা থাকত সেটা ১৫০০ বছর আগের মানুষরা কীভাবে ব্যাখ্যা করত? আমি আজকে একটা বই লিখলাম। কিন্তু সেটা এক হাজার বছর পরের মানুষ বুঝবে। তো এখনকার মানুষদের জন্য সেটা মূল্যহীন। একটা সার্বজনীন পথনির্দেশক হচ্ছে কম্পাসের মতো, আপনি যে দিকেই ঘুরেন সে সঠিক রাস্তাই দেখাবে।

এই সহজ, সার্বজনীন কুরআনের সাথে চল্লিশ লক্ষ হাদিস আর অসংখ্য তাফসির, মাসলা-মাসায়েল, দোয়া-দরুদের বই জুড়ে যে প্রকাণ্ড ঢেঁকি আমরা বানিয়েছি তার কোনো কূল-কিনারা নেই।

 নবীজির বক্তব্য নামে যেসব হাদিস প্রচলিত সেসব হাদিসের সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণের ঐতিহাসিক বাস্তবতা, এসব হাদিস অনুমোদনের ভিত্তি এবং হাদিসে নিঃশর্ত বিশ্বাসের পক্ষে প্রদত্ত যুক্তি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।

▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১

▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



🌹 ধন্যবাদ 🌹

Post a Comment

Previous Post Next Post