সুখের সংসার (এক) মফিজুল ইসলাম।

 "সুখের সংসার"



দুটি কথা

আনন্দ বিগলিত হৃদয়ে শত-কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি সেই মহান সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামীনের, যার একান্ত অনুগ্রহ ও সীমাহীন দয়ায় আত্মপ্রকাশের যাবতীয় স্তর অতিক্রম করে 'সোনালী সংসার' নামক উপন্যাসখানা আলোর মুখ দেখতে পেরেছে। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যার সোনালী দাম্পত্য জীবন সবার জন্যই অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য।

'সোনালী সংসার' আমার প্রথম উপন্যাস। এটি কেমন হলো কিংবা উপন্যাসকে আদৌ উপন্যাস বলা যায় কিনা সে বিচারের ভার পাঠক- পাঠিকাদের হাতে। তবে এটা জোর দিয়েই বলতে পারি, সোনালী সংসারকে সব দিক থেকে সুন্দর ও সুখপাঠ্য করার জন্য আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলো না। তদুপরি মুহতারাম সম্পাদক সাহেব ছাড়াও আরো কয়েকজন বিজ্ঞ ব্যক্তিকে এর পান্ডুলিপি দেখিয়েছি এবং তাঁদের পরামর্শ মোতাবেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছি। এতসত্ত্বেও বিদগ্ধ পাঠক-পাঠিকারা যদি এই উপন্যাসের ত্রুটি বিচ্যুতি ও ভালো মন্দের দিকগুলো তুলে ধরে দু'কলম লিখে পাঠান তবে সত্যিই অত্যন্ত খুশি হবো। সেই সঙ্গে আগামীতে উপন্যাস লিখার ক্ষেত্রে উপকৃত হবো যথেষ্ট পরিমাণে।


মাসুম-ফারহানা এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। এরাই সোনালী সংসারের কেন্দ্রবিন্দু। এদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। আমি এ উপন্যাসে দেখাতে চেয়েছি, স্বামী-স্ত্রী দীনদার এবং একে অপরের সহযোগী হলে পারিবারিক জীবনেই কেবল শান্তি আসে না, সমাজের লোকজনও উপকৃত হয় যথেষ্ট পরিমাণে; অনেক পথহারা বিপথগামী মানুষও পথের সন্ধান পায়; উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত হয় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে।

যারা এ উপন্যাস লিখা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন তাদের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ। বিশেষ করে ইসলামিয়া কুতুবখানার মালিক মাওলানা মুহাম্মদ মোস্তফা সাহেবের ঋণ কোনো দিন আমি শোধ করতে পারবো না। কারণ তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি উপন্যাস লিখার ব্যাপারে আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। এমনকি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাবাজারের এক লাইব্রেবী থেকে নিজের পকেট থেকে প্রায় সাতশ'রও অধিক টাকার উপন্যাস কিনে দিয়েছেন। সত্যিই তাঁর এ অবদান কখনো ভোলার নয়। আল্লাহ সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন আরেকটি কথা। হৃদয় গলে সিরিজের ১৭তম খন্ডের মতামত বিভাগটি শুধুমাত্র কবিতা দ্বারা সাজানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সুতরাং ছোট বড় সব ধরনের কবির নিকট অতি শীঘ্র কবিতা পাঠানোর অনুরোধ রইল। আর হ্যাঁ, এর পুরস্কার কিন্তু প্রথম ১০ জন কিংবা ১টি বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং সবাইকে ডবল অর্থাৎ দুটি করে বই উপহার দেওয়া হবে। পরিশেষে সকলের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করে এখানেই শেষ করছি।

দোয়াপ্রার্থী

মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম

তাং ১২/১১/০৫ইং

সেদিন ছিলো পূর্ণিমা। জ্যোছনা ভরা রাত। নাজিয়া ঝরনার পাশে একটি পাথর খণ্ডে একা একা বসে আছে। জ্যোছনার আলো ঝরনার পানিতে এক অপূর্ব ছন্দের সৃষ্টি করে চলেছে। ফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাগানের চারদিকে। নাজিয়া আপন মনে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত বারবার তিলাওয়াত করছে। তার সুললিত কন্ঠের সুমিষ্ট আওয়াজ সমস্ত বাড়ির স্তরে স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।

নাজিয়া এখন স্বামীর বাড়িতে। বাড়িটি বেশ বড়। রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। চারদিকে পাকা দেয়াল। গেইট দিয়ে ঢুকেই রাস্তার বাম দিকে একটি সুন্দর বাগান। সেই সাথে ঝরনা। নাজিয়ার শ্বশুর জামিল সাহেব একজন ধার্মিক ও রুচিশীল লোক। বাড়ি নির্মাণের সময় আলো বাতাসের পাশাপাশি পর্দা-পুশিদার দিকটিও তিনি গুরুত্বের সাথে খেয়াল রেখেছেন।

একটু পূর্বে নাজিয়া ইশার নামাজ আদায় করেছে। নামাজ শেষে কায়মনোবাক্যে স্বামীর জন্য মোনাজাত করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জামিল সাহেব জরুরি এক কাজে স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে গেছেন। এখনও ফিরেন নি। যাওয়ার সময় বলে গেছেন, বউমা! আমাদের ফিরতে একটু দেরি হবে। তোমরা সাবধানে থেকো।

বাড়িতে এখন নাজিয়া ছাড়াও আছে তাহের ও তামান্না নামক তার দুই সন্তান এবং কাজের ছেলে সোহাইল। তাহের ও তামান্না খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুতরাং বাড়িটিকে এক রকম নির্জনই বলা চলে। আর এই নির্জনতার সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে নাজিয়া। একটু উঁচু আওয়াজেই তেলাওয়াত করছিল সে। সেই সাথে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল প্রিয়তম স্বামীর জন্য।

নাজিয়ার স্বামীর নাম মাসুম। তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। ১০ দিন গত হলো তিনি বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এর পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে পাবনা গিয়েছেন। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ তিনি বাসায় ফিরছেন। দুপুরের দিকে ফোন করে স্ত্রীকে সংবাদটা জানিয়ে দিয়েছেন।

❤️❤️

এক বুক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নাজিয়া স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে। তার হৃদয়ে আজ এক অদ্ভুত অনুভূতি। একটা কেমন যেন উম্মাদনা তার সমস্ত অন্তরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। একটা অভূতপূর্ব আনন্দে হৃদয়-মন নেচে উঠছিল তার।

নাজিয়া যখন ঢাকা গোলাপবাগ মহিলা মাদরাসার কুদুরী জামাতের ছাত্রী তখনই তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরও সে লেখাপড়া বন্ধ করে নি। পড়াশুনার প্রতি প্রচন্ড ঝোঁকের কারণে শ্বশুর-শ্বাশুড়ী ও স্বামীর অনুমতি নিয়ে সে আরও চার বছর লেখাপড়া করে দাওরায়ে হাদীস শেষ করেছে। ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্রী হওয়ায় সবাই তাকে আদর করতো। বড়রা স্নেহের দৃষ্টিতে

দেখতো আর ছোটরা আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতো। আর সেও সবার সাথে হাসিমুখে ভদ্রতার সাথে কথা বলতো। বিপদে আপদে এগিয়ে যেত। কোনো ছাত্রী পড়া না বুঝলে বা কেউ কোনো পড়া জিজ্ঞেস করলে সে কোনোরূপ বিরুক্তিবোধ না করেই সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলে দিত। কোনো ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে জান প্রাণ দিয়ে তার সেবা করতো। মাথায় পানি দিত। সময় মতো ঔষধ খাওয়াতো। 

কাপড় চোপড় ধুয়ে দিত। এমনকি নিজের হাতে খানা খাওয়াতো। অসুস্থ মেয়েটি গরিব হলে নিজের টাকা দিয়ে পথ্য-ঔষধ ইত্যাদি কিনিয়ে আনত। মোটকথা শুধু ভালো ও মেধাবী ছাত্রী হিসেবেই নয়; সুন্দর, ভদ্র, মার্জিত ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য সকলের নিকট সে ছিলো পরম প্রিয়।

❤️

জ্যোছনার আলোতে পাথর খণ্ডে বসে নাজিয়া যে আয়াতটি একাধিকবার তেলাওয়াত করছিল তা ছিল সূরা রুমের ২১ নং আয়াত। আয়াত খানা যতবার তেলাওয়াত করছিল ততই ভালো লাগছিল তার। অফুরন্ত আনন্দ উচ্ছ্বাসে তার দীপ্ত উজ্জ্বল মুখখানা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। হৃদয়ের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে মনোহারিণী সুরে যে আয়াতখানা সে পাঠ করছিল তার অর্থ হলো-

"মহান আল্লাহ পাকের নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসা ও দয়া দান করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নির্দেশাবলি রয়েছে।১

মাদরাসার ছাত্রী হওয়ার কারণে নাজিয়া কুরআনের অর্থ বুঝত। সে যখন আয়াত খানা তেলাওয়াত করছিল তখন এর অর্থ ও ভাব বারবার তার হৃদয়পটে ভেসে উঠছিলো। সে ভাবছিলো, বিয়ের পূর্বে সর্বপ্রথম যেদিন এ আয়াত ক্লাসে পড়েছিলাম, সেদিন এর বাহ্যিক অর্থ বুঝলেও মর্মার্থ বুঝি নি।

কিন্তু এখন........। এতটুকু চিন্তা করে সে নিজেই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো।

❤️

নাজিয়া আজ দশ দিন যাবত স্বামীকে দেখে নি। স্বামীর মধুর ডাক এ কয়দিন তার হৃদয়ে সুধা বর্ষণ করে নি। কিন্তু নাজিয়ার কাছে দশ দিন যেন দশ মাসের মতো মনে হচ্ছে। সময় যেন ফুরাতে চায় না। প্রথম দুই তিন দিন এতটা খারাপ না লাগলেও দিন বাড়ার সাথে সাথে অন্তরে হাহাকার আর শূণ্যতা যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দুপুরের ফোন পাওয়ার পর এ কয়টি ঘন্টা যেন শেষই হতে চাচ্ছে না।

স্বামীকে একান্ত করে কাছে পাওয়ার এই অপেক্ষার প্রহরে নাজিয়ার আজ কত কথা মনে পড়ছে। কত স্মৃতি, কত দৃশ্য উঁকি-ঝুকি মারছে তার হৃদয়ের আয়নায়। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছে সে।

স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে আটকে গেলো নাজিয়া। তার হৃদয়পটে ভেসে উঠলো এমন একটি দৃশ্য, সেই সাথে মনে পড়লো এমন একটি ঘটনার কথা, যা আজও সে ভুলতে পারে নি। ভুলতে পারবেও না কোনোদিন। বস্তুত এ মুহূর্তে ঘটনাটি মনে পড়ায় আজ যেন আয়াতের মর্মার্থটি আরও বেশি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তার কাছে।

বাসর রাতে নাজিয়া যখন স্বামীকে একান্ত আপন করে কাছে পেয়েছিলো, যখন স্বামীর বুকে মাথা রেখে কল্পনার পাখায় ভর করে ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্ন দেখছিলো, ঠিক তখনই স্বামীর মুখ থেকে এ ঘটনাটি শুনেছিলো সে।

নাজিয়ার স্বামী মাসুম অত্যন্ত ভালো মানুষ। সেও এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নাজিয়াকে বিয়ে করেছে। তার একান্ত আশা, স্ত্রী নাজিয়াকে নিয়ে এমন এক সুখের নীড় রচনা করবে যার নজির বর্তমান পৃথিবীতে খুব কমই আছে। গড়ে তুলবে এমন একটি সোনালী সংসার যা থেকে অন্যান্য দম্পতিরাও ছবক গ্রহণ করতে পারবে।

❤️

বাসর রাতে এক আনন্দঘন মুহূর্তে মাসুম বললো, নাজিয়া! আজকের এই মধুর রজনীতে কোনো ঘটনা শুনিয়ে সময় নষ্ট করতে যদিও মন চাইছে না, তথাপি না বলে থাকতে পারছি না। তবে আমার বিশ্বাস, কথাগুলো তোমারও ভালো লাগবে। শুনবে কি তুমি?

নাজিয়া এতক্ষণে স্বামীর সাথে ফ্রি হয়ে গেছে। সংকোচ ও জড়তা বিদায় নিয়েছে বেশ আগেই। সে বলল, অবশ্যই বলবেন। আপনি কোনো কথা বলতে চাইবেন, আর আমি শুনবো না, এটা কখনোই হতে পারে না!

নাজিয়াদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া রেল স্টেশন সংলগ্ন মৌড়াইল গ্রামে। তাদের মূল বাড়ি সরাইল থানার পানিশ্বর গ্রামে হলেও বছর দশেক আগে তার পিতা ইসমাঈল খাঁ এখানে এসে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ ছায়াঘেরা এ বাড়িটি স্টেশন থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ট্রেনের যাত্রীরা জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালে অনায়েসে তা দেখতে পারে। 

বিয়ের পর মাসুম-নাজিয়ার প্রথম রাত্রিটি এ বাড়িতেই কেটেছিলো। স্ত্রীর কথায় মাসুম খুব খুশি হলো। বললো, নাজিয়া! তুমি কেবল দেখতেই সুন্দর নও, কথায়ও সুন্দর।

নাজিয়া বললো, দুআ করবেন, আল্লাহ পাক যেন কাজেও সুন্দর বানিয়ে দেন। আপনার সেবা করে, মন খুশি রেখে দুনিয়া থেকে যেন বিদায় নিতে পারি- রাব্বুল আলামীনের নিকট সর্বদা এ কামনাই করি।

আল্লাহ পাক তোমার মনের বাসনা পূর্ণ করুক, একথা বলে স্ত্রীকে আরো গভীরভাবে কাছে টেনে নেয় মাসুম। এরপর বলতে থাকে-

❤️❤️

নাজিয়া! গতকাল রবিবার বাদ আছর বিশ্ব ইজতেমায় তোমার আমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। একথা তুমিও জানো। প্রথমে আমার ইচ্ছা ছিল সোমবার দিন আখেরী মোনাজাত শেষে বাড়ি ফিরবো। তারপর আল্লাহ পাকের যখন মর্জি হয় তখন তোমার সাথে সাক্ষাত করবো। কিন্তু বিয়ের কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর সময় যতই যেতে লাগলো ততই অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলো। রাতটা কোনো রকমে ছটফট করে কাটালাম।

ফজরের নামাজ আদায় করার পর অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেলো। একদিকে মোনাজাত, অপরদিকে তুমি। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কাছে হেরে গেলাম। মন বললো, আখেরী মোনাজাত শেষে ইজতেমার ময়দান থেকে বাড়ি ফিরতেই অনেক রাত হয়ে যাবে। তখন তো আর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় থাকবে না। সুতরাং বাধ্য হয়েই পরবর্তী রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। নাজিয়ার চন্দ্রমুখ দেখতে এত বিলম্ব, তা কি তোমার সইবে?

আমার মনের এ অস্থিরভাব চোখে মুখেও ফুটে উঠলো। ঘনিষ্ট কয়েকজন মুরুব্বীর সাথে পরামর্শ করলাম। তারা চেহারা দেখেই আমার মনের অবস্থা বোধ হয় টের পেয়েছেন। তাই বললেন, তুমি অমুক অমুককে নিয়ে এখনই বাড়ি চলে যাও, আমরা আখেরী মোনাজাত শেষে ফিরব ইনশাআল্লাহ।

মুরুব্বীদের কথা শুনে মনটা আনন্দে কানায় কানায় ভরে উঠলো। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাদের জন্য দুআ এলো। অনুমতি পেয়ে দেরি করলাম না। সঙ্গে সঙ্গে টঙ্গী রেল স্টেশনে চলে এলাম।

❤️❤️

একটু পর একখানা আন্তঃনগর ট্রেনের খবর হলো। কাউন্টারে গিয়ে টিকেট বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজান! এ ট্রেনখানা বি, বাড়ীয়া থামবে কি? তিনি বললেন, এমনিতো থামে না তবে ইজতেমা উপলক্ষে থামবে।

আমরা লোকটির কথা বিশ্বাস করে ট্রেনের অপেক্ষায় রইলাম। একটু দাঁড়াতেই ট্রেন এসে গেলো। গাড়িতে লোকজন তেমন ছিলো না। আমরা ঝটপট উঠে আসন গ্রহণ করলাম। ট্রেন চলতে লাগলো। কিছুক্ষণ চলার পর পাশে উপবিষ্ট একজন যাত্রীকে নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, ভাই! এ ট্রেনখানা বি, বাড়ীয়া স্টেশনে স্টপিজ দিবে কি? লোকটি নির্দ্বিধায় বলে উঠলো, না।

লোকটির ছোট্ট এক 'না' শব্দে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেলো। তবে একথা ভেবে সামান্য আশ্বস্ত হলাম যে, লোকটি হয়তো জানে না যে, ইজতেমা উপলক্ষে মহানগর ট্রেনটি বি, বাড়ীয়া স্টপিজ দিবে।

কিন্তু একটু পর বিশ্বাস হলো, লোকটির কথাই ঠিক। কেননা গার্ডকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সেও একই উত্তর শোনাল। সেই সাথে অন্যান্য যাত্রীরাও বলল, লাকসামের আগে এই ট্রেন কোথাও থামবে না।

আমি তাদেরকে বললাম, টঙ্গী স্টেশন থেকে আমাদেরকে তো বলা হয়েছে, এই ট্রেন ইজতেমা উপলক্ষে বি, বাড়ীয়াসহ আরো কয়েকটি স্থানে স্টপিজ দিবে।

তারা বলল, যিনি আপনাদেরকে একথা বলেছেন তিনি এ ব্যাপারে ভালোভাবে না জেনেই বলে দিয়েছেন।

আমি বললাম, এখন তাহলে কি করতে পারি আমরা?

লোকজন বলল, এখন কিছুই করার নেই। লাকসাম গিয়ে ট্রেন থামলে সেখান থেকে ট্রেন কিংবা বাসে করে বাড়ি ফিরতে হবে।

❤️❤️

নাজিয়া! লোকেরা যখন এ কথাগুলো বলছিলো তখন ট্রেনখানা তোমাদের বাড়ী অতিক্রম করছিলো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বুকটা তখন ব্যথায় চিনচিন করে উঠল। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ এক দৃষ্টে তোমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। 

ট্রেন নামক যন্ত্রটির উপরও ভীষণ রাগ হলো। মনের অজান্তেই বেরিয়ে এলো, দেখো না, এ নিষ্ঠুর দানবটি কেমন করে আমাকে প্রেয়সী থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বারবার চেইন টানতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। ভাবলাম, যদি কর্তব্যরত লোকজন জিজ্ঞেস করে, ট্রেন থামালেন কেন? তবে কী জবাব দিব। 

তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য কি নিদারুন যন্ত্রণা, কি কাল বৈশাখীর ঝড় বয়ে চলছে আমার হৃদয় জগতে সে কথাতো আর আন্যকে বলা যায় না। সুতরাং ট্রেন তার আপন গতিতে পাগলের মতো ছুটে চলছে তো চলছেই।

বিশ্বাস করো নাজিয়া! তখন যে আমার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিলো তা তোমাকে ভাষায় বুঝাতে পারবো না। বিয়ে হতে না হতেই একটি অচেনা অজানা মেয়ের জন্য হৃদয়ের টান এতটা প্রবল হতে পারে, তা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারি নি। এতটুকু বলে মাসুম থামলো।

নাজিয়া এতক্ষণ স্বামীর কথাগুলো তন্ময় হয়ে শুনছিলো। স্বামী থেমে যেতেই ছোট্ট করে বললো-

: তারপর?

: তারপর কি আর করা! সীটে বসে তাসবীহ হাতে জিকির করতে লাগলাম। খোদায়ী ফয়সালাকে দিল থেকে মেনে নিলাম। সেই সাথে চিন্তা করে বের করলাম যে, এত কষ্ট করে টঙ্গীর ময়দানে গিয়েও আখেরী মোনাজাতে শরিক না হয়ে চলে আসার কারণেই আমার এ পেরেশানী এসেছে। কেননা, যিনি যে কাজ গুরুত্ব দিয়ে করেন তিনি যদি ঐ কাজে শৈথিল্য বা অবহেলা প্রদর্শন করেন, তবে খোদার পক্ষ থেকে বিপদ আসে। 

আমি যেহেতু তাবলীগকে নিজের কাজ বানিয়ে নিয়েছিলাম, অত্যন্ত পাবন্দির সাথে এর বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করতাম, সেই আমিই যখন তাবলীগের এক আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন- বিশ্ব ইজতেমা শেষ না করে, মোনাজাতে শরিক না হয়ে চলে যাচ্ছি, কাজেই পেরেশানী তো কিছু হবেই।

ট্রেন এতক্ষণে আখাউড়া স্টেশন ছাড়িয়ে গেছে। বিরামহীনভাবে চলছে সে। থামার কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমি খোদার দিকে মনোনিবেশ করলাম। গভীর আন্তরিকতাসহ তাকে স্মরণ করলাম। মনে মনে দুআ করলাম-

❤️❤️

ওগো রাহমানুর রাহীম দয়াময় প্রভু! এখন আমার মনের কি অবস্থা তা তুমি ভালো করেই জানো। ওগো মাওলা! তুমি তোমার বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করো। তার কৃত অপরাধকে মার্জনা করে দাও। বিশ্ব ইজতেমার আখেরী মোনাজাতে শরিক না হয়ে প্রিয়তমের সাক্ষাতকে প্রাধান্য দিয়ে আমি মহা অন্যায় করে ফেলেছি খোদা। এ অন্যায়ের জন্যই আজ আমার এতবড় পেরেশানী হচ্ছে। এত কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হয়েছি আমি।

 ওগো রাব্বুল আলামীন! তুমি আমাকে মাফ করে দাও। যদি ট্রেন সত্যি সত্যিই লাকসামের পূর্বে কোথাও না থামে তাহলে আজকে আর নাজিয়ার সাথে সাক্ষাত সম্ভব হবে না। ওগো মাবুদ! তুমি তো সর্বশক্তিমান। সব কিছুই পার তুমি। তোমার অসাধ্য কিছুই নেই খোদা। তুমি তোমার বান্দার উপর অনুগ্রহ করো। যে কোনো উপায়ে ট্রেন থামার ব্যবস্থা করো। নইলে আমার অবস্থা কি হতে পারে, তুমিই তা আমার চেয়ে ভাল জানো।

নাজিয়া! বিশ্বাস করো, আমি এ কথাগুলো এতটাই দৃঢ়তার সাথে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছিলাম যে, আমার মনে হচ্ছিলো, আল্লাহর অপরিসীম কুদরতে এই বুঝি ট্রেন থেমে গেলো। আর বাস্তবেও হয়েছিলো তাই।

হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা'আলা বলেন, বান্দা আমার সাথে যেমন ধারণা রাখে আমি তার সাথে তেমন ব্যবহার করি।

এ হাদীস খানা তখন আমার পূর্ণরূপে স্মরণে ছিলো। সাথে সাথে একথাও আমার এক্বিন ছিলো যে, বান্দা যদি নিজের গোনাহের কারণে কোনো বিপদাপদের সম্মুখীন হয় আর তখন সে গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন, মেহেরবান খোদা তার অপরিসীম দয়ায় তাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।

❤️❤️

নাজিয়া! তুমি শুনে আশ্চর্য হবে যে, আমার দুআ শেষ হতে না হতেই গাড়িটি এমন একটি স্টেশনে এসে হঠাৎ করে থেমে গেলো, যেখানে থেকে অতি সহজে টেম্পু ও বাস যোগে দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসা যায়। 

🌹আরো পড়ুন🌹

সালামুন আলাইকুম, নাকি শুধু সালাম, নাকি আসসালামু আলাইকুম কোনটি ঠিক

আরও মজার কথা হলো, যদি গাড়িটি আগের ২/৩টি স্টেশনের যে কোনো একটিতে থামত, তবে পথ কম হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণে কয়েকগুণ সময় বেশি লাগতো।

গাড়ি স্টেশনে থামার সাথে সাথে আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই! এখানে কি এ গাড়ির ষ্টপিজ আছে? লোকটি বললো- না, স্টপিজ নেই। মনে হয় বিশেষ কোনো কারণে থেমেছে। আমি এ ট্রেনে বহুদিন যাবত আসা-যাওয়া করি। কিন্তু কোনো দিন এখানে থামে নি। যাক আপনার জন্য ভালই হলো। অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে পারবেন।

আল্লাহ পাকের সাহায্য পেয়ে মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হলো। তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এলো।

❤️ সুখের সংসার (দুই) ❤️

মনে মনে অসংখ্যবার আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম।


Post a Comment

Previous Post Next Post