আপনার ধর্মই আপনার অ্যাটিচিউড
(সজল রোশন)
কোনো বস্তু বা পদার্থের ধর্ম বলতে আমরা খুব সহজেই বুঝি সে বস্তু বা পদার্থের সহজাত বৈশিষ্ট্য। যেমন আগুনের ধর্ম তাপ দেয়া বা পুড়িয়ে ফেলা। একজন মানুষের বেলাতেও এ কথাগুলো সমানভাবে প্রযোজ্য। আমার-আপনার ধর্ম মানে আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য।
আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস, ভাবনা বা আচরণ। এই সহজাত বৈশিষ্ট্যকেই ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় অ্যাটিচিউড বা মানসিকতা। আপনার অ্যাটিচিউড মানে আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যা করেন। পজিটিভ অ্যাটিচিউড বলতে আমরা বুঝি তিনি অভ্যাসবশত ভালো কাজ করেন।
তিনি সব সময় সত্য কথা বলেন, মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করেন, চুরি করেন না, দায়িত্বে অবহেলা করেন না, প্রতারণা বা অসৎ পন্থা অবলম্বন করেন না, অনর্থক আলাপে মগ্ন থাকেন না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। পৃথিবীর যে কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী বা কর্মকর্তা নিয়োগের সময় এ গুণগুলো নিশ্চিত হতে চায়। কারণ এ মানুষগুলোকে নিয়ে কর্মক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ- অনুযোগ থাকে না, এদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখতে হয় না।
আর নেগেটিভ অ্যাটিচিউড মানে এরা অকারণে মিথ্যা কথা বলে, খারাপ ভাষায় তর্ক করে, অনর্থক কথায় বা কাজে মগ্ন থাকে, সুযোগ পেলেই চুরি করে, আমানতের খেয়ানত করে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, দায়িত্বে অবহেলা করে, প্রতিবেশী বা সহকর্মীকে সাহায্য করে না। এমন মানুষদের পর্বতপ্রমাণ যোগ্যতা থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠান এদের কর্মী বা কর্মকর্তা হিসেবে নিতে চায় না।
মানুষ এদের সম্মান করে না, বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না, নেতা হিসেবে মেনে নিতে চায় না, এদের জীবনসঙ্গীও হতে চায় না। কারণ এদের নিয়ে জীবনে, কর্মক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সমস্যা সৃষ্টি হয়, সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখতে হয়। বিচার-সালিশ, অভিযোগ-অনুযোগের অন্ত থাকে না। সুতরাং চাকরি, ব্যবসা, সমাজ, সংসার, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সাফল্যের ভিত্তি হচ্ছে ইতিবাচক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি।
আমাদের ধর্ম হচ্ছে আমাদের অ্যাটিচিউড বা আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত আচরণের বহিঃপ্রকাশ। আমি যখন বলব আমার ধর্ম হচ্ছে ইসলাম তো আমার আচার-আচরণ, বিশ্বাস, ভাবনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামি বিধি-নিষেধ ফুটে উঠবে। যার ধর্ম হিন্দু তার সহজাত বৈশিষ্ট্যে বেদ বা গীতার শিক্ষা স্পষ্ট থাকতে হবে। খ্রিস্টান মানে তার চরিত্রে বাইবেলের প্রতিফলন থাকবে। কিন্তু আমরা কতজন আমাদের নিজ নিজ ধর্মের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ?
বিভিন্ন পোশাকি রীতি-রেওয়াজ, প্রথা, পার্বণ, মুখস্থ কিছু দোয়া-তাবিজ, কিচ্ছা- কাহিনির একটা অর্থহীন প্যাকেজকে আমরা ধর্ম হিসেবে চর্চা করি, যার সাথে • প্রকৃত ধর্মের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। যাই হোক, আমি ধর্মপ্রচারক নই, তাই মানুষকে ধর্মে দীক্ষিত করা আমার কাজ নয়। কে কী বিশ্বাস করবে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়।
আমি মানুষের এই ধর্মবিশ্বাসের সাথে তার আচার- আচরণের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা, ভুল চর্চা কীভাবে মানুষকে ধর্মের দৈত্যে রূপান্তরিত করে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। আমার মূল উদ্দেশ্য আপনাকে কিছু চিন্তার খোরাক দেয়া, কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করা, দিন শেষে আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। উদাহরণ হিসেবে আমি ইসলাম ধর্মের কথাই বেশি বলব; কারণ অন্য ধর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞান তুলনামূলক কম।
ধর্ম বিশ্বাস বা অবিশ্বাস আমাদের চরিত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে। কোনো পেশাগত লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাই ধর্মীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। এটা অনেকটা একটা ভবন বানানোর আগেই যেমন সিভিল অ্যাভিয়েশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয় নইলে মাঝপথে গিয়ে একটা উভয় সংকটে পড়বেন। আপনি ধর্ম বিশ্বাস, অবিশ্বাসকে পাত্তা না দিলেও ধর্ম আপনার সামনে এসে দাঁড়াবেই।
একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির এই জয়যাত্রায় যারা ধর্মকে অসার, অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন, তাদের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বরং আমাদের ব্যক্তিগত, পেশাগত জীবনে ধর্মের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলছে। নেটিজেনদের মধ্যে বিতর্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় টোপ বা টপিক হচ্ছে ধর্ম।
এখনকার পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি ধর্মের চর্চা হয় আবার প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে অসংখ্য দল, উপদল তো আছেই এবং যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যও নানান শ্রেণিবিভাগ আছে, যেমন- চরমপন্থী নাস্তিক, যারা দুনিয়ার তাবৎ সমস্যা শুধু ধর্মের মধ্যেই দেখে, ধর্ম ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো সমস্যা নেই। এদের মধ্যে চরম উগ্রপন্থী ধর্মবিদ্বেষী গ্রুপ আছে, যারা সুযোগ পেলে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ হত্যায় দ্বিধাবোধ করে না বা করবে না।
ইউরোপ, আমেরিকায় সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন বা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অন্যতম প্রধান একটি টার্গেট ধর্মবিদ্বেষী, উগ্র বর্ণবাদী গ্রুপ।
উদারপন্থী নাস্তিকরা ধর্ম বিশ্বাস করে না, পালন করে না কিন্তু অন্যদের ধর্ম পালনে তাদের কোনোই আপত্তি নেই।
সংশয়বাদী নাস্তিকরা ধর্ম নিয়ে মাথাই ঘামায় না; তাদের বিশ্বাস হচ্ছে আল্লাহ থাকলে ভালো; না থাকলে আরো ভালো।
ছদ্মবেশী নাস্তিকরা ধর্ম পালন করে না। কারণ সিরিয়াসলি ধর্মে বিশ্বাস করে না; তবে সেটা জনসম্মুখে প্রকাশ বা প্রচার করে না।
আরেক শ্রেণি পুরোপুরি ভণ্ড, প্রতারক; এরা বিরাট বড় ধার্মিকের বেশ ধরে জাস্ট মানুষ ঠকায়। এরা নিজের লাভ অনুযায়ী ধর্মকে বিশ্বাস করে, পালন করে বা ব্যবহার করে। কিন্তু ধর্মের কিছুই এরা বিশ্বাস করে না।
তবে ধর্মবিষয়ক বিতর্ক মোটামুটি অন্তহীন এবং ফলাফলহীন একটা বিতর্ক। তাই এই বিতর্কে জেতার সবচেয়ে ভালো কৌশল হচ্ছে বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া। দিন শেষে যার যার ধর্ম তার তার, সবার কাছে সবার ধর্ম ঠিক।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা একবার বিচার কাজ পরিচালনা করতে বসলেন, তিনি প্রথমে বাদীর কথা শুনে বললেন-
হুম, তোমার কথাই ঠিক।
এরপর আবার বিবাদীর কথা শুনে বললেন-
হুম, তোমার কথাই ঠিক।
তো হোজ্জার বউ বাড়ির ভেতর থেকে বলল-
এ আবার কেমন বিচার? দুজনের কথাই ঠিক হয় কীভাবে?
তখন হোজ্জা বলল-
হুম, তোমার কথাই ঠিক।
আসলেই আমাদের সবার কথাই ঠিক। কারণ আমরা একেকজন একেকভাবে দেখছি, একেক জায়গা থেকে দেখছি।
আমরা সাধারণত সেটাই বিশ্বাস করি, যা আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে।
আরেকজন মানুষও তাই বিশ্বাস করে যা তাকে বিশ্বাস করানো হয়েছে। আমরা দিনভর আমাদের বিশ্বাসের পক্ষেই যুক্তি জোগাড় করি। আপনার-আমার সামনে
যুক্তি-প্রমাণের বুফে সাজিয়ে দিলেও আমরা আমাদের পছন্দমতো যুক্তিই পাতে তুলব।
তবে সস্তা, অশালীন যুক্তিকে আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি বানালে সে বিশ্বাস আপনাকে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যাবে, এসব যুক্তি আপনাকে গোঁড়া বানাবে, ধার্মিক নয়। এমন অনেক বই বা ভিডিও হাস্যকর এবং সস্তা যুক্তিতে ভরা কিন্তু দুঃখজনকভাবে 'সস্তা জিনিসের চাহিদা বেশি'-এই সূত্র অনুযায়ী এসব বই বা বক্তার কাটতি বেশি।
সস্তা যুক্তি নিয়ে কারো সাথে তর্ক করতে গেলে বরং পরিবেশটাই নষ্ট হয়, তাই যে বই আপনাকে অন্ধ করে, যে বই আপনাকে বন্ধ করে, সে বই আপনি পড়বেন না।
ধর্মে বিশ্বাস বা ধর্ম পালনের জন্য আপনার এসব খোঁড়া যুক্তির দরকার নাই। এসব সস্তা যুক্তি আপনাকে ফলাফলহীন বিতর্কের কিছু রসদ যোগান দিবে কিন্তু ধর্মের যে প্রকৃত সৌন্দর্য তা থেকে আপনাকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে নিবে।
বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।